ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জগন্নাথ হল
জগন্নাথ হল, যার অবদান এবং গুরুত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে যে তিনটা হল জন্ম নিয়েছিলো তাদের মধ্যে একটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পূর্বে পূর্ববঙ্গে 9টি কলেজ ছিলো। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজ। 1884 সালে বালিয়াটির জমিদার শ্রী কিশোরী লাল সাহা(রায় চৌধুরী) তার পিতা জগন্নাথ সাহার নামানুসারে জগন্নাথ কলেজ স্থাপন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯২০(The University Of Dacca Act 1920) অনুসারে 1921 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা কলেজ হতে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হতো। 1921সালেই তিনটা হল স্থাপন করা হয়- ঢাকা হল(ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল), জগন্নাথ হল, মুসলিম হল(সলিমুল্লাহ মুসলিম হল)। জগন্নাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার কিশোরী লাল জগন্নাথ হলের জন্য ভূমি দান করলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন হলের নাম জমিদার বাবুর পিতা জগন্নাথ সাহার নামানুসারে করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিট্রিশ সরকার দক্ষিন বাড়ি(South building) কে সেনাব্যারাক এবং হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার সাউথ বিল্ডিং(south building) কে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবন(রেজিস্ট্রার অফিস) এবং সাউথ-ইস্ট ভবনকে(south-east building) পাকিস্থান এসেম্ব্যলি(সংসদ) ভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। বাংলা ভাষা কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী এখানেই প্রথম উত্থাপিত হয়েছিলো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1926 সালে একবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। ১৯৩৬সালে তাকে ডিলিট উপাধি দিলেও সেবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন নি। জগন্নাথ হলে আসার কথা থাকলেও হটাত অসুস্থ হয়ে পড়ায় সশরীরে আসা হয়নি তার। ১৯২৬ সালের ১৫ফেব্রুয়ারী তিনি জগন্নাথ হলের বার্ষিক ম্যাগাজিনের(বাসন্তিকা) জন্য তার “এই কথাটি মনে রেখো” কবিতা প্রেরন করেন। পরবর্তীতে কবিতাটি গান হিসেবে বেশি পরিচিতি লাভ করে। বুদ্ধদেব বসুও এই সংখ্যায় লিখেছিলেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনায় বক্তব্য দেন এবং তাদের বার্ষিক ম্যাগাজিনের জন্য “উদ্ধোধন” নামে একটা ইংরেজি কবিতা পাঠান। এছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচীর অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর –Meaning of Art ও The Rule of The Giant নামে দুটো ইংরেজি প্রবন্ধ পাঠ করেন।
অমুসলিম শিকার্থীদের বাসস্থান হওয়ায় পাকিস্তানিদের সহজ টার্গেট ছিলো এই হল। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আক্রমনে মারা যান এই হলের অনেক আবাসিক শিক্ষক, ছাত্র এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দর্শন বিভাগের প্রধান ড.গোবিন্দ চন্দ্র দেব(1907-1971)। ড.জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা(ইংরেজি),তিনিই ছিলেন ১৯৭১ সালে হল প্রাধ্যক্ষ। অনেকের অনুরোধ পরেও ছাত্রদের ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে জাননি তিনি। এছাড়া, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য(ইতিহাস), অদ্বৈতপায়ন ভট্টাচার্য(পদার্থ বিজ্ঞান), রাধা গোবিন্দ সাহা(অর্থনীতি) ।
১৫ অক্টোবর,১৯৮৫ সাল। রাত ৮টা,বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন প্রচারিত হচ্ছিলো জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক- শুকতারা। টিভি রুম ছিলো লোকে ভর্তি, ঠিক তখনই এই দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু, দুর্গাপুজোর ছুটিতে তারপরের দিনই বাড়িতে যাবার কথা ছিলো সবার। সেই রাতে ছাদ ধ্বসে ২৬ শিক্ষার্থী সহ ৪০ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছিলো প্রায় ৩০০ জন। ১৯৮৮ সালে পুরনায় ভবনটি চালু করা হয়। এরপর থেকে এই ভবনের নাম রাখা হয়- অক্টোবর স্মৃতি ভবন। এই দিনটি প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন জগন্নাথ হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ। তিনি 1921 থেকে1924 পর্যন্ত হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তখন প্রাধ্যক্ষ ছিলেন ড.রমেশ চন্দ্র মজুমদার। জগন্নাথ হলের বর্তমান প্রাধ্যক্ষ হলেন- ড. মিহির লাল সাহা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুসলিম শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস হলো জগন্নাথ হল। জগন্নাথ হলে আছে- খেলার মাঠ, টেনিস কোর্ট, পুকুর, উপসনালয়, বৌদ্ধমূর্তি, বিবেকান্দ মূর্তি। জগন্নাথ হলের বিশেষ আকর্ষন হলো স্বরস্বতী পূজা। প্রতি বছর প্রতিবিভাগের শিক্ষার্থীরা পূজা করেন। এছাড়া, কালিপুজো, দুর্গা পূজার আয়োজন করা হয় প্রতিবছর। এভাবেই দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে শতোবছরের পা দিতে চলছে দেশের এই প্রাচীন ছাত্রাবাস।
তথ্যসূত্রঃ
Jagannath Hall alumni association of Canada.
Wikipedia.
প্রথম আলো, ০৩ আগস্ট,২০১৮, সৌমিত্র শেখর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্র রচনা।
Bdnews24, 13 october,2005
BBC.
No comments